সরিষা বাংলাদেশের প্রধান ভোজ্য তেল ফসল। বর্তমানে প্রায় সাড়ে ৩ লক্ষ হেক্টর জমিতে এর চাষাবাদ করা হয় এবং প্রায় আড়াই লক্ষ টন তেল পাওয়া যায়। বিভিন্ন জাতরে সরিষার বীজে প্রায় ৪০-৪৪% তেল থাকে। খৈলে প্রায় ৪০% আমিষ থাকে। তাই খৈল গরু ও মহিষের জন্য খুব পুষ্টিকর খাদ্য।
1. চাষের মৌসুম :
বিভিন্ন অঞ্চলের তারতম্য এবং জমির জো অবস্থা অনুসারে টরি-৭, কল্যাণীয়া, সোনালী সরিষা, বারি সরিষা-৬, বারি সরিষা-৭ ও বারি সরিষা-৮ এর বীজ মধ্য আশ্বিন থেকে মধ্য-কার্তিক মাস (অক্টোবর) পর্যন্ত বোনা যায৷ রাই-৫ এবং দৌলত কার্তিক থেকে অগ্রহায়ণ (মধ্য-অক্টোবর থেকে মধ্য-নভেম্বর) মাস পর্যন্ত বপন করা যেতে পারে৷
দেশের উত্তরাঞ্চলও দক্ষিণাঞ্চলে যথাক্রমে অক্টোবর ও নভেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সরিষার বীজ বুনতে হয়৷ দেশের মধ্যাঞ্চলে অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে বীজ বুনতে হয়৷ নেপাস জাতের সরিষা মধ্য নভেম্বর পর্যন্ত বপন করা যায়৷
2. পুষ্টিগুন:
প্রতি ১০০ গ্রাম সরিষায় খাদ্যশক্তি রয়েছে ৬৬ ক্যালরি,শর্করা ৭.৭৮ গ্রাম, আমিষ ৩.৯৫ গ্রাম, খাদ্য আঁশ ৩.২ গ্রাম,সোডিয়াম ১১২০ মিগ্রা,পটাশিয়াম ১৫১ মিগ্রা,ক্যালসিয়াম ৮%, আইরন ১০% ইত্যাদি।
3. উপযুক্ত জলবায়ু :
4. মাটির ধরন :
উর্বর ও মধ্য উর্বর দোআঁশ ও পলি দোআঁশ মাটি সরিষা চাষের জন্যে উত্তম৷ মাটির বর্ণ গাঢ় ধূসর হওয়া ভালো৷ লালমাটি বা কাঁকড়যুক্ত মাটিতে সরিষার চাষ ভালো হয় না৷ মাটির অম্লমান ৬.০ থেকে ৭.০ এর মধ্যে থাকলে উত্তম৷ লোনা মাটিতে সরিষা ভালো হয় না৷ বর্ষায় পলি জমি এমন মাটি চাষের জন্যে ভালো৷ শুষ্ক অবস্থায় ফাটল ধরা মাটিতে সরিষা ভালো হয় না৷
উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমি সরিষার জন্যে ভালো৷ আগাম পানি নিকাশ হলে মাঝারি নিচু জমিতে চাষ করা যায৷ উঁচু-নিচু জমিতে সরিষার চাষ করা যায় না৷ জমি উন্মুক্ত স্থানে হওয়া দরকার, যাতে সেখানে সারাদিন রোদ পড়ে৷ বর্ষাকালে প্রধানত বোনা আমন ও রোপা আমনের জমিতে শীতকালীন ফসল হিসেবে সরিষার চাষ করা হয়৷ এছাড়া আন্তঃফসল হিসেবে উর্বর জমিতে এবং ফল বাগানে সরিষার চাষ করা যায়৷
5. জমি তৈরি পদ্ধতি:
জমিতে ৪-৬টি চাষ মই দিয়ে তৈরি করতে হবে৷ চাষ কম হলে সরিষা বীজের অঙ্কুরোদগমে বিঘ্ন ঘটে৷ মাটির জো অবস্থায় জমি চাষ দিতে হবে৷ এতে মাটিতে ঢেলা থাকবে না, মাটি সমতল হবে৷ জমি চাষ করর সময় আগাছা ভালোভাবে বাছাই করতে হবে, যাতে ফসলে আগাছার প্রকোপ কম হয়৷ সরিষা জমির চাষ ১০-১২ সেন্টিমিটার গভীরে হওয়া দরকার৷ সরিষা জমিতে চাষ করার ফাঁকে ফাঁকে রোদ লাগতে হবে৷ পাওয়ার টিলার দিয়ে চাষ দিলে ২-৩টি চাষই যথেষ্ট, তবে ভালোভাবে চাষ-মই দিয়ে জমি সমতল করতে হবে৷
6. বীজ বপন পূর্বে করণীয়:
বীজ বপনের পূর্বে ভিটাভেক্স-২০০ অথবা ক্যান্টন দিয়ে (২-৩ গ্রাম ছত্রাক নাশক/ কেজি বীজ) বীজ শোধন করে বপন করতে হবে৷ বিনা সরিষার বীজ ব্যাভিষ্টিন (২.৫ গ্রাম/ কেজি) বা বেনলেট (১.৫ গ্রাম/ কেজি) দিয়ে শোধন করতে হবে৷
7.বীজ বপন পদ্ধতি:
বাংলাদেশ প্রধানত সরিষার বীজ ছিটিয়ে বপন করা হয়৷ তবে সারিতে বীজ বপন করলে ফসলের পরিচর্যা করতে সুবিধা হয়৷ অবশ্য সারিতে বীজ বুনতে কিছু অতিরিক্ত ব্যয় হয়৷
⇒ বীজের হার:
প্রতি হেক্টর ৭-৮ কেজি, গাছ সংখ্যা প্রতি বর্গমিটারে ৪৫ থেকে ৬৫টি (গাছের ধরন অনুসারে)৷
⇒ সারির দূরত্ব: সারি থেকে সারির দূরত্ব ২৫ থেকে ৩০ সেন্টিমিটার৷
8. সার প্রয়োগ পদ্ধতি:
ইউরিয়া বীজ বপনের ৩০ থেকে ৪৫ দিনের মধ্যে ১-২ বার প্রয়োগ করতে হবে৷
ইউরিয়ার উপরিপ্রয়োগ প্রয়োগ করতে হবে৷
ইউরিয়ার উপরিপ্রয়োগের পূর্বে জমির আগাছা দমন করতে হবে৷
অর্ধেক ইউরিয়া ও অন্যসব সার জমি তৈরির সময় প্রয়োগ করতে হবে৷
ইউরিয়ার উপরিপ্রয়োগের পর জমিতে সেচ দিতে হবে৷
9. সেচ ব্যবস্থাপনাঃ
সোনালী সরিষা, বারি সরিষা ৬ (ধলি), বারি সরিষা ৭ ও বারি সরিষা ৬ উফশী জাতসমূহ পানি সেচ দিলে ফলন বেশি হয়৷ বীজ বপনের ২৫-৩০ দিনের মধ্যে (গাছে ফুল আসার আগে) প্রথম সেচ এবং ৫০-৫৫ দিনের মধ্যে (ফল ধরার সময়) দ্বিতীয় সেচ দিতে হবে৷ বপনের সময় মাটিতে রস কম থাকলে চারা গজানো ১০-১৫ দিনের মধ্যে একটা হালকা সেচ দিতে হবে৷ সেচের নিশ্চয়তা থাকলে সার বেশি দিতে হবে৷
10. আগাছা দমনঃ
বীজ বপনের ১৫-২০ দিন পর একবার এবং ফুল আসার সময় একবার নিড়ানি দিতে হয়৷
11. পোকার আক্রমণ ও দমনঃ
সরিষাতে বিভিন্ন জাতের পোকার আক্রমণ হতে পারে৷ এসব পোকার মধ্যে প্রধান প্রধান ক্ষতিকর পোকা এবং প্রতিকার বা দমনের পদ্ধতি আলোচনা করা হলো৷
সরিষার জাব পোকা
ক্ষতির লক্ষণ:
প্রতিকার :
12. ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণ:
সংগ্রহঃ টরী জাতীয় সরিষা ৭০-৯০ দিন এবং রাই জাতীয় সরিষা ৯০-১২০ দিনের ৭০-৮০% ফল / শুঁটি পরিপক্ক হলে শুটিসহ গাছ খড়ের রং ধারণ করে। এ সময় গাছ কেটে ফসল সংগ্রহ করুন।
সংরক্ষনঃ রোদে শুকানোর পর গরম অবস্থা বীজ সংরক্ষণ করলে অংকুরোদগম ক্ষমতা কমে যেতে পারে। তাই রোদে শুকানো বীজ ঠান্ডা বায়ুরোধী পাত্রে, টিনে বা ড্রামে পুরাপুরি ভরে মুখ বায়ুরোধী করে বন্ধ করুন। ইদানিং ভারি পলি ব্যাগে বীজ ভরে তা চটের বস্তায় ঢুকিয়ে রাখা সাশ্রয়ী প্রযুক্তি। বীজপাত্র অপূর্ণ থাকলে বা পাত্রের মুখ ভালভাবে না আঁটকালে বীজের গজানোর হার কমে যাবে।পাত্রের মুখে ও গায়ে লেবেল বা বীজের বিবরণ লিখে/ চিহ্ন দিয়ে রাখুন। সংরক্ষণের জন্য বীজ ভর্তি পাত্র মাটির সংস্পর্শে না রেখে মাচার উপর রাখুন। বীজপাত্র কম আর্দ্র ঘরের শীতল স্থানে রাখুন।